লিগ্যাল মনোপলি : এক মানবিক সমীক্ষণ

এম.নেপোলিয়ন টুডু ।। বৃহস্পতিবার।। ১৬ই এপ্রিল।।
এক ভয়ঙ্কর ভাইরাস আজ আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। যাইহোক কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারের সদর্থক কিছু পদক্ষেপ, এর চরম ভয়াবহতা অনেকটাই প্রতিরোধ করতে পেরেছে। সরকারীভাবে রেশনদ্রব্য বন্টন, অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ত্রানসাহায্য ইত্যাদীর মাধ্যমে সাধারন জনজীবন অনেকটাই সচল বলে মনে হচ্ছে। তবুও এই করোনা ভাইরাস আজ আমাদের সামনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকগত অনেক প্রশ্নই সামনে নিয়ে এসেছে।এরকমই একটি বিষয় আজ সকলের কাছে উপস্থাপন করলাম।
সরকারীভাবে লক্ডাউন ঘোষনা হওয়ার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে, প্রায় অর্ধমৃত হয়ে কোনোরকমে নিজের ঘরে পৌঁছতে পেরেছে।এখনো অনেক মানুষ অনাহারে,অর্ধাহারে থেকে আপন গ্রামে ফিরতে চাইছে ।তারা হয়তো আসতে চায়নি ।কিন্তু দিনের পর দিন মালিকের চোখরাঙানি, প্রশাসনের রক্তচক্ষু, বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে নিরুপায় হয়ে আবার স্বদেশের পথ ধরা।লাভের লাভ অবশ্য কিচ্ছু হয়নি।উল্টে জুটেছে পুলিশের লাঠিপেটা, প্রতিবেশির গালিগালাজ ও ভয়ার্ত হুড়োহুড়ির সৌজন্যে ক্ষুধিত শরীরে হার্টফেল হওয়ার সৌভাগ্য। মিডিয়ায় ফুটে উঠেছে তাদের করুন মুখের অবয়ব।চ্যানেলের টিআরপি বেড়েছে, মধ্যবিত্ততার খাতিরে লাইক,শেয়ার,কমেন্টের বন্যা বয়েছে। পরিসংখ্যানের গ্রাফ কখনো উর্ধমুখী আবার কখনো নিম্নমুখী হয়েছে।কিন্তু তারা রয়েছে সেই তিমিরেই। কারোর বাড়িতে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী,কারোর বাড়িতে সদ্য জন্মানো বাচ্চা,আবার কারোর বাড়িতে অপেক্ষারত পঙ্গু বৃদ্ধা মা।
এতক্ষণ যাদের কথা বলাহলো এরা সবাই খেটেখাওয়া মানুষ। এইসব মানুষ ব্যতিত অনেকেই নিজের নিজের বাড়ি পৌচেছে।কারন তাদের টাকা আছে, তারা সবাই ধনী। কোনোকোনো ক্ষেত্রে আবার সরকারী সহযোগিতায় এলিট্রা বাড়ি পৌছে বেশ আয়েশী জীবনযাপনে ব্যস্ত। আর যেসব গরীব মানুষ বাড়িতে আছে, ক্যামেরার সামনে পোজ্ দিতে দিতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একশো দিনের কাজ নেই, চিকিৎসার টাকা নেই খামোকা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে তারা কি করবে! কাজে প্রতারনা, আবাস যোজনার টাকায় কমিশন, রেশনকার্ড বন্দক, মিনিব্যাঙ্কে আঙুলের ছাপ বসিয়ে টাকা লোপাট – এসব বাদদিয়ে তাদের থাকে কি?শেষমেশ নামালখাটতে যাওয়া অথবা ভিনরাজ্যে জীবন বাজিরেখে উপার্জনের আশায় দুপা বাড়ানো। লোকাল ট্রেনে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনতে শুনতে গন্তব্যে পৌছানো।
গরীব, অসহায়,খেটেখাওয়া এইসব মানুষদের অবস্থা আমরা আগেও জেনেছি। এদেরকে নিয়ে কত গল্প,নাটক,কবিতা, গান লেখা হয়েছে। প্রতিচী ট্রাস্টের মতো কত সংস্থা এদের নিয়ে গবেষনা করছে। অর্থনীতির কত ছাত্র যে এইসব দিনআনি দিনখাই মানুষের উপর থিসিস লিখে পিএইচডি ডিগ্রী হাঁসিল করেছে তার ইয়ত্তা নেই।তবুও গরীবের পেটে দুবেলা অন্ন জোটেনা।এর থেকে জটিল বিষয় আর কিবা হতে পারে!
জঙ্গলমহলের মতো ঐসব মানুষদের এলাকার কথা লিখতে গেলে শেষ হবেনা। আমাদের রাজ্যের জঙ্গলমহলের কথায় ভাবাযাক্। জমি আছে ফসল নেই,শস্য আছে ফলন নেই, পতিত জমি আছে শিল্প নেই।আহা কি দারুন অবস্থা! শোনাগেছে এখানে আবার কোলকাতা থেকে বাবুরা সুটিং করতে আসে। দংলাগ্ড়ে, ছৌ নাচ দ্যাখে,আদিবাসী নারীর শরীর দ্যাখে তারা ফিরে চলে যায়।এরপর এইসব ছবি কানচলচিত্র উৎসবের মতো কোনো জায়গার থেকে আর্ন্তজাতিক অনেক পুরস্কার জিতে নিয়ে আসে। আর এখানকার ভূমিপুত্রদের কপালে জোটে অনাহারের পুরস্কার।
এইসব এলাকায় শিল্প হয়না।কিন্তু শিল্পের জন্য শ্রমিকের জোগান এখান থেকেই হয়। বাম, ডান,অগ্নি,নৈঋত কোনো রাজনৈতিক দলেই বলেনা এখানে শিল্প হোক। কিন্তু ব্রিগেড কিংবা যুবভারতী ভর্তি হয় এইসব এলাকার মানুষদের দিয়েই। এখানকার জনপ্রতিনিধিরাও এইরকমই হয়।তারা পার্টির দালালি ছাড়া আর কিছু করেনা। যুগেযুগে সব বদলায় কিন্তু এইসব এলাকা বদলায় না। ছোটো বড়ো মাঝারি শিল্প থাকলে হয়তো সাধারন মানুষের এতো হাহাকার হতে হতো না।সাথে কিছুটা কৃষিজ ব্যবস্থার পরিকাঠানো, পর্যাপ্ত জলের যোগান থাকলে গরীব মানুষদের এতো হায়রানি হতে হতো না ।
এরপর আসা যাক পাড়ায়, গ্রামে, পঞ্চায়েতে ,ব্লকে, জেলায় থাকা কুকুরের মতো পাচাটা স্বভাবের, শিয়ালের মতো ধূর্ত কিছু রাজনৈতিক দালালদের কথায়। গরীব মানুষদের কাছ থেকে মোটা কমিশন নিয়ে তারা বাড়ি গাড়ি মোচ্চবে ব্যস্ত ।এদের জন্যই আজ খেটেখাওয়া মানুষদের এই অবস্থা। এখন এদের অনেকেই পাড়ায় পাড়ায় ত্রানবিলির নামকরে সেলফি তোলায় ব্যস্ত। রেশনের চাল লোপাট করে চাল বিলিতে ন্যস্ত । ত্রান তহবিলেও দান দক্ষিনায় সিদ্ধহস্ত। এরাই আসল ভদ্রলোক !
আসুন এইসব মানুষদের নিয়ে এই সঙ্কটময় মূহুর্তে সাহায্য সহযোগিতার সেতু গড়ে তুলি। নুহ্য, কন্টকময় এদের জীবনজিবীকা নিয়ে পরোক্ষভাবে হলেও সরব হই । সমস্তস্তরের মানুষের সহযোগিতা হয়তো অদূরভবিষ্যতে এদের আগত প্রজন্মের ভার অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারবে।অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে সবাইকে নিয়েই বেঁচেথাকার। সচেতনতার সঙ্গেই মনে রাখতে হবে
___ “যারে তুমি নীচে ফেল
সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে
সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে ।।”
এম.নেপোলিয়ন টুডু ।। বৃহস্পতিবার।। ১৬ই এপ্রিল।।